সিডর-আইলায় ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত না হওয়ায় জোয়ারের পানি ঢুকে বরগুনার আমতলী উপজেলার আরপাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের কৃষিক্ষেত্র বিপর্যস্ত হয়ে পড়্।ে ফসল উৎপাদনে ধস নামায় লোকসানের মুখে পড়ে কয়েক হাজার কৃষক । কয়েক বছরের লোকসানে কৃষকেরা যখন কৃষিক্ষেত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন, তখন স্থানীয় ঘোপখালী গ্রামের এক নারী হতাশ কৃষকদের মনে নতুন আশা জাগিযে তোলেন। তিনি কেঁচো সার তৈরি ও তা দিয়ে সবজি চাষ করে নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন এবং অন্যদেরও স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তাঁর এবং অন্য নারীদের সাফল্য দেখে বিমুখ কৃষকেরাও আবার ফিরে এসেছেন কৃষিকাজে। এখন এলাকার ৪০ ভাগ কৃষক ধান ও অন্যান্য ফসল উৎপাদনে ব্যবহার করছেন কেঁচোর জৈব সার। এতে ঘুচে গেছে কৃষির অচলায়তন । এক সময়ের হলদে- বিবর্ণ ফসল খেতগুলোয় এখন গাঢ় সবুজের ছড়াছড়ি। ধান ও সবজির উৎপাদনও বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। নেপথ্যে থেকে নির্ভৃত গ্রামের যে নারী এতো মানুষের চোখ খুলে দিয়েছেন তাঁর নাম শাহিনূর বেগম (২৮) । কেবল নিজের গ্রাম নয় আশপাশের গ্রামগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর সাফল্যগাথা। কঠোর সংগ্রাম আর দুর্দমনীয় ইচ্ছাশক্তি দিয়ে মানুষ নিজে ও সমাজকে বদলাতে পারে শাহিনূর তার দৃষ্টান্ত। সেই আত্মবিশ্বাসের ছাপই দেখা গেল তাঁর চোখেমুখে। তবে তাঁর জীবন জয়ের এই গল্পটাও কম মর্মস্পর্শী নয়।
দুর্বিসহ অতীত: ঘোপখালী গ্রামের আবদুল লতিফ মাষ্টারের দুই ছেলে -মেয়ের মধ্যে ছোট শাহিনূরের ইচ্ছা ছিলো উচ্চ শিক্ষিত হবেন। কিন্তু তা হয়নি। পারিবারের ইচ্ছায় ২০০০ সালের শেষ দিকে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী শাহিনূরকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। বর পার্শ্ববর্তী গ্রামের প্রবাসী যুবক। পরিবারের ইচ্ছাকে মূল্য দিযে তিনি স্বামীর সংসারে যান। দেড় বছরের মাথায় তাদের সংসারে আসে এক কন্যা সন্তান। স্বামী -সন্তান নিয়ে সুখেই দিন কাটছিলো । কিন্তু তা বেশী স্থায়ী হয়নি । আকষ্মিক তাঁর স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। জীবনটাকে তখন নিরর্থক মনে হয় । ক্ষোভে-অভিমানে আত্মহননের সিদ্ধান্ত নেন শাহিনূর। কিন্তু ছোট্ট মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তা পারেননি। সংসার জীবনে হেরে যাওয়া শাহিনূর একদিন সবার অগোচরে মেয়েকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে এক কাপড়ে চলে আসেন বাবার বাড়ি । তারপর কেটে গেছে ১১ বছর । মেয়ে রুবি এখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে।
শুরুর কথা: বাবার বাড়িতে এসেও স্বস্তি মেলেনি তাঁর । কতদিন বাবা-মায়ের মুখাপেক্ষী থাকবেন-এই ভাবনায় বিষিয়ে ওঠে মন । নিজের ও মেয়ের অনিশ্চিৎ ভবিষ্যতের কথা ভেবে দিন-রাত শুধু চোখের জলে ভাসেন । এভাবে বছর খানেক চলার পর স্থির করেন যে করেই হোক নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। পড়াশোনা করার সময় পাওয়া উপবৃত্তির কিছু টাকা তিনি মায়ের কাছে জমা রেখেছিলেন। এই টাকায় দশটি হাঁস কিনে শুরু করেন ঘুরে দাঁড়াবার সংগ্রাম। বছর ঘুরতে হাঁসের খামার থেকে বেশ আয়ও করেন। এই অর্থ দিয়ে পরের বছর তিনটি ছাগল কেনেন এবং বাড়ির পরিত্যক্ত জমিতে শুরু করেন সবজিচাষ। ৩-৪ বছর এসব করে হাতে আসে হাজার বিশেক টাকা। এই টাকায় ৩০ শতক জমি বন্দক নিয়ে শুরু করেন সবজিচাষ। কিন্তু ফলন ভাল না হওয়ায় লোকসানে পড়েন। এতে হতাশ হন শাহিনূর । কিন্তু থেমে যাননি।
২০১২ সালের শুরুর দিকে শাহিনূর তাঁর চাচার পরামর্শে ‘সংগ্রাম’ নামে স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে কেঁচো দিযে জৈব সার তৈরির প্রশিক্ষণ নেন। সংস্থাটি ওই বছরই প্রথম বরগুনা-পটুয়াখালী জেলায় এই কাজ শুরু করে। প্রশিক্ষণের পর সংস্থা থেকে বিনামূল্যে চারটি রিং স্লাব ও আট হাজার কেঁচো পান। সকাল-বিকাল মাঠে ঘুরে গোবর সংগ্রহ করে রিংগুলো ভরিয়ে তোলার কাজ শুরু করেন। কেঁচো নিয়ে এমনিতেই এলাকার লোকজনের মধ্যে বিরূপ ধারনা আছে। তার উপরে মাঠে-ঘাটে গোবর সংগ্রহ করায় লোকজনের নানা কথা শুনতে হয় তাঁকে । শাহিনূর তাতে দমেন না। গোবর সংগ্রহ শেষে স্লাবের ভেতর কেঁচো ছাড়েন। তিন মাস পর চারটি স্লাব থেকে প্রায় ৩০০ কেজি সার পান। সঙ্গে পান আট হাজার কেঁচোর বাচ্চা। সার ১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় তিন হাজার টাকা। কেঁচো বিক্রি করে পান আরো আট হাজার টাকা। এ আয় শাহিনূরকে অদম্য করে তোলে।
বন্দক নেওযা জমিতে এই সার দিয়ে পুনরায় শুরু করেন সবজিচাষ। এবার সবজি চাষেও সাফল্য আসে । লাউয়ের ডগাগুলো মোটা, লক-লকে আর ঘণ সবুজ হয়ে ওঠে। দুধসাদা ফুলে ছেয়ে যায় মাচা। শিম, বরবটি, করলা, মরিচ, টমেটো, খিরাই গাছগুলোও লাল-নীল -হলুদ-বেগুনি ফুলে ভরে ওঠে। ঝ্াঁক বেধে আসতে থাকে ফলন। এরপর আর পিছু ফিরতে হয়নি তাঁকে ।
সার উৎপাদন ও সবজি আবাদ করে গত দুবছরে দুই লাখ টাকা দিয়ে ৩০ শতক জমি কিনে সেখানে দেড় লাখ টাকায় দোতলা টিনের ঘর করেছেন। এ বছর ৬৪ হাজার টাকায় আরো ১৫ শতক জমি ও ৩৫ হাজার টাকায় কিনেছেন দুটি গাভী। প্রতিদিন গড়ে আয় করছেন প্রায় ১১০০ টাকা। শাহিনূর জানান, এবার তিনি শিম বিক্রি করে ৩০ হাজার , মরিচ বিক্রি করে ১১ হাজার , পেঁপে ও কলা বিক্রি করে ২৯ হাজার ; শশা, বরবটি, বেগুনসহ অন্যান্য সবজি বিক্রি করেছেন প্রায় ২৬ হাজার টাকা। কেঁচো সার বিক্রি করে মাসে গড়ে আয় হয় প্রায় আড়াই হাজার টাকা।
শাহিনূর বলেন, আমার ইচ্ছা এলাকার নারীরা নিজের পায়ে দাঁড়াক। তবেই তারা পরিবারে ও সমাজে সম্মান পাবে।
আরপাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘একজন নারী তাঁর চেষ্টা ও শ্রম দিয়ে নিজের ভাগ্য বদলাতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না । শাহিনুরের এই সাফল্য সারা দেশের নারীদের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। ’
শাহিনূরের গ্রামে একদিন: আমতলী উপজেলা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে আরপাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের ঘোপখালী গ্রাম । পাকা ও মেঠো পথ পার হয়ে শাহিনূরের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির আঙ্গিনায় দোচালা কুড়ে ঘরে আটটি স্লাবে সার তৈরির সরঞ্জাম রাখা। সেখানে বেশ কয়েকজন নারীকে কেঁচো সার তৈরির পদ্ধতি দেখাচ্ছেন।
এদেরমধ্যে নাজমা বেগম নামে একজন বলেন, শাহিনূর আপার পরামর্শে এহন মোরা আয় করতে পারি। আগে স্বামীর রোজগারে সংসার চলতো, এহন মোরা সংসারে টাকা দিতে পারি বইলা মনটা ভাল লাগে।
বাড়ি থেকে বের হয়ে একটু পূর্বে এগোতেই আরেক সফল নারীর খোঁজ পাই। নাম মিঠু রাণী (৪০) । তিনিও শোনালেন তাঁর দু:খ, সংগ্রাম ও সাফল্যের গল্প। বলতে গিয়ে একসময় গলা ধরে এলো তাঁর। ছলছল চোখে জানালেন, ১০ বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর নি:সন্তান মিঠু রাণী আশ্রয় নেন বাবার বাড়িতে। স্বামী- সংসার-সন্তান ও সম্বলহীন এক কঠিন জীবনে কেবল উপেক্ষাই মিলেছে তাঁর। হতাশা, একাকীত্ব আর উপেক্ষিত জীবনে যখন আর ক’ল ছিলো না তখন শাহিনূর তাঁর পাশে দাঁড়ান। শাহিনুরের পরামর্শে বছর দেড়েক আগে তিনিও কেঁচো সার তৈরি শুরু করেন। দুই শতক জমিতে করেন পানের বরজ ও সবজিচাষ । সেটা এখন দশ শতকে ঠেকেছে। এ বছর পান, সবজি ও সার বিক্রি করে আয় করেছেন দেড়লাখ টাকার মতো । এখন মিঠু রাণীর ধ্যান-জ্ঞান এই খেত-খামার। তারিকাটা গ্রামের রুশিয়া বেগম (৪৫) এখন আটটি স্লাবে সার বানাচ্ছেন। পতিত জমিতে লাউ ও শিমের চাষ করে আয় করেছেন ৪৩ হাজার টাকা। একইভাবে ফাহিমা , সাজেদা , তাসলিমা , জয়ফুল বিবি, কুলসুম , সোকানূর , বিউটি , বিপাশা, শারমিন , ফারহানাসহ অনেক নারীর সাফল্যের গল্প যেন ফুরাতে চায়না। এর জ্যোতি ছড়িয়ে পড়েছে পার্শ্ববর্তী খোন্তকাটা, বালিয়াতলী, পূর্ব তারিকাটা, পাতাকাটা, চাকামাইয়া, হুমা, বাহেলাবুনিয়াসহ আশপাশের অনেক গ্রামে।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি-বনায়ন বিভাগের প্রধান ড. আলমগীর কবির বলেন,জৈব সার ব্যবহারে ফলন ১০ থেকে ৩৫ গুণ বাড়ে । এতে মাটিতে খনিজ পদার্থের সাম্য বজায় এবং পুষ্টির সরবরাহ বাড়ায়। এই সার দীর্ঘদিন ব্যবহারে লবণাক্ততার মাত্রা হ্রাস পাওযার সম্ভাবনা থাকে।
তিনি বলেন, আমি আমতলীর ওই এলাকায় কয়েকবার গিয়েছি এবং লবণাক্ততার কারণে সেখানকার কৃষির বিপর্যয় নিজ চোখে দেখেছি। শাহিনূরের মতো নারীরা কঠোর পরিশ্রম করে এলাকার বিপর্যস্ত কৃষিক্ষেত্রকে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে এটা সত্যি আমাকে বিষ্মিত করেছে।
আমতলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহ আলম বলেন, শাহিনূরের দেখাদেখি ঘোপখালীসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামগুলোতে কৃষিতে নিরব বিপ্লবের সূচনা হচ্ছে।