মোঃ ইব্রাহিম খলিল, বয়স-৪২ বছর। গ্রামের নাম বাইশাখোলা, পোঃ ছোট বালিয়াতলী, উপজেলা কলাপাড়া, জেলা পটুয়াখালী। পিতার নাম আবদুল মোতালেব হাওলাদার মাতার নাম আলেয়া বেগম। তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী। পা চিকন এবং মেরুদন্ডে সমস্যা। এ সমস্যার কারনে সে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটে। তিনি এসএসসি পাশ করেছেন। বর্তমানে একজন গ্রাম ডাক্তার হিসেবে স্থানীয় মানুষের সেবা দিয়ে থাকেন এবং বালিয়াতলী চৌরাস্তায় ঐষধ বিক্রির একটি ছোট্ট ফার্মেসী আছে।
আজ থেকে ২৭ বছর আগের কথা। ইব্রাহিমের পরিবার নি¤œবিত্ত। বাবা প্রান্তিক কৃষক। সামান্য জমিজমা চাষের পাশাপাশি চৈত্রমাসে তার বাবা তালগাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করতো। ইব্রাহিম এই কাজে বাবাকে সহযোগিতা করতো। ১৭ বছর বয়সের সময় একদিন তালগাছ থেকে রস সংগ্রহ করার সময় হঠাৎ ইব্রাহিম তালগাছ থেকে পরে যায়। যদিও তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন কিন্তু কমরে বড় ধরনের চোটের কারনে প্যারারাইসড হয়ে যান। কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করলে ডাক্তাররা তাকে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উচ্চতর চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করেন। পরে সেখান থেকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহন করেন। তারপরেও ইব্রাহিম সম্পূর্ন সুস্থ হতে পারেননি। একটি পা চিকন হয়ে যায়, একটি পায়ের গোড়ালি ক্ষতিগ্রস্থতা থেকেই যায় এবং কমরে ব্যাথা বিদ্যমান থাকে। হাটার সুবিধার জন্য তিনি সিডিডি থেকে উপকরণ হিসেবে এএফও পেয়েছে।
ইব্রাহিম বেশিরভাগ সময় বিছানায় কাটাতো। নির্জিবের মত অলস সময় পার করতে গিয়ে তার মাথায় বিভন্নি স্বপ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। সমাজের মানুষের সেবা করার প্রবল ইচ্ছা তাকে ঘর থেকে বাইরের দুনিয়ায় বের করে। এটাসেটা চেষ্টা করার পর একসময়ের ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ইব্রাহিম ২০০৩ সনে বাংলাদেশ গ্রাম ডাক্তার সমিতির আওতায় কলাপাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পল্লী চিকিৎসার উপর এক মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। পটুয়াখালীর সিভিল সার্জন তাকে সনদপত্র প্রদান করেন।
এবারে স্থানীয় মানুষের সেবার ব্রত নিয়ে তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে অসুস্থ রোগিদের সেবা করা শুরু করে বিনা পারিশ্রমিকে। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের। যেহেতু তিনি নিজে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সেখান থেকেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উপর মমত্ববোধ তাকে এই উৎসাহ জোগায়। ইব্রাহিমের বাড়ি থেকে কলাপাড়া ১২ কিলোমিটার দূরে কিন্তু রাস্তাঘাট না থাকায় এবং বিশাল নদী এই দূরত্ব অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে অসুস্থ রোগি নিয়ে নদী পার হয়ে যাওয়াই মুস্কিল। কাজেই প্রতিবন্ধী ইব্রাহিম তাদের ভরসা হয়ে দাড়ায়। ইব্রাহিম তাই প্রতিবন্ধীতার কষ্টটাকে বুকের কোনে চেপে রাখার জন্য প্রানান্তকর চেষ্টা করে রুগিদের সেবা দেয়।
সিডিডি’র সহযোগিতায় স্থানীয় বাস্তবায়নকারী সংস্থার মাধ্যমে ২০১০ সনে মিঠাগঞ্জ এলাকায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য পরিচালিত পিএইচআরপিবিডি প্রকল্প শুরু হয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে এই প্রকল্পের কাজ। ইব্রাহিম এই প্রকল্পের কর্মকান্ড সম্পর্কে এই প্রকল্পের লোকবলের কাছে জানতে পায়। আগে থেকেই পরোপকারী ইব্রাহিমের মাথায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কিছু করার চিন্তাভাবনা চলছিলো। তিনি এই সুযোগটি কাজে লাগানোর জন্য মিঠাগঞ্জ এলাকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা করে। ইব্রাহিম খলিল যেহেতু তাদের কাছে একজন বিশ^স্ত মানুষ। সবাই তার কথায় রাজি হয়ে যায়।
৫ জুন ২০১০ তারিখে মিঠাগঞ্জ এলাকায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে মিঠাগঞ্জ প্রতিবন্ধী স্বসংগঠন। শুরু হয় তার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারের আন্দোলন। ১৫জন নারী-পুরুষের এই স্বসংগঠনটিতে নিজেই সভাপতি নির্বাচিত হন। সিডিডি থেকে বিভিন্ন সচেতনতামূলক বার্তা নিজে গ্রহন করে স্বসংগঠনের সকলের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেন। একসময় মিঠাগঞ্জ প্রতিবন্ধী স্বসংগঠনের মাধ্যমে এ্যাডভাকেসি, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ, স্কুলে প্রতিবন্ধী শিশু ভর্তি জন্য চিহ্নিত করা এবং ভর্তি করা, আয়বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ ও কর্মকান্ডে অর্ন্তভূক্তির জন্য উদ্যেগ গ্রহণ এবং বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ, সচেতনতা মূলক সভা পরিচালনাসহ স্ব-সংগঠনের অন্যান্য চাহিদা ভিত্তিক কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করতে থাকে। এর প্রেক্ষিতে এই স্বসংগঠনটির সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে ইব্রাহিম খলিলের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার কারনে তিনি একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। স্থানীয় মানুষেরা প্রতিবন্ধীতার ভিতরের কথা জানতে পারে। তাদের প্রতি মমত্ববোধ তৈরি হয়। সমাজের বিভিন্ন সুবিধা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দেয়। মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন হয়। সমাজে, ইউনিয়ন পরিষদে, বিচার-শালিসে, সরকারি নিরাপত্তাবেস্টনী কর্মকান্ডে, স্কুলের কমিটিতে, স্থানীয় সামাজিক উদ্যোগে এখন প্রতিবন্ধী ব্যত্তিদের অন্তর্ভূক্তি একটি বড় রকমের সামাজিক ইতিবাচক পরিবর্তন এনে দেয়। এর মূল নিয়ামক ইব্রাহিম খলিল।
ইব্রাহিমের লেখাপড়ার খুব ইচ্ছা ছিলো কিন্তু দুর্ঘটনা তার সেই স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি তাই তার স্বপ অন্যদের মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য এবারে তার বাড়িতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এলাকায় আর কোন স্কুল না থাকায় অল্প দিনেই তার সরকারি হয়ে যায়। হঠাৎ একটি জটিলতা তৈরি হয় স্কুলের জমি নিয়ে। ইব্রাহিমের প্রতিষ্ঠিত স্কুলে তার পৈত্রিক প্রাপ্ত সামান্য জমি ও নিজ নামে প্রতিবন্ধি ব্যক্তি হিসেবে প্রাপ্ত সরকারি খাঁশ জমি লিখে দেয়। একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সহায়তায় খাঁশজমিটুকু স্থানীয় একজন নেতা সরকারি কর্মকর্তাদের প্রভাব খাটিয়ে নিজ নামে নিয়ে নেয় এবং দখলের জন্য আসে। এই পরিস্থিতিতে ইব্রাহিম তার আশপাশের প্রতিবন্ধী স্বসংগঠন ও অ্যাপেক্সবডির সদস্যদের নিয়ে পর্যায়ক্রমে এসি ল্যান্ড, ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা প্রশাসকের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে পূণরায় সেই জমি পিরিয়ে নিতে সমর্থ হয়।
চিকিৎসার মাধ্যমে এলাকায় কল্যাণের প্রভাব, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুনাম আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন তৈরি ও তাদের জোট বেধে প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার আদায়ের কর্মকান্ড জোড়দার হলে ইব্রামি ও তার স্বসংগঠন ইউনিয়নে এক নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এর ফলে ইব্রাহিমকে শালিস মিমাংসায় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দায়িত্ব প্রদান করে। স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটিতে সভাপতি করা হয়। ইউনিয়ন পরিষদের স্ট্যান্ডিং কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। পিএইচআরপিবিডি প্রকল্পের অ্যাপেক্সবডিতে সভাপতি নির্বাচিত হয়। উপজেলা গ্রাম ডাক্তার সমিতির কমিটিতে পদ দেয়া হয়। ভিজিডি বাছাই কমিটিতে তার মতামত নেয়া গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রতিবন্ধী সনদ তথ্য গ্রহনে তার মতামত গ্রহন করা হয়।
ইব্রাহিম তার চিকিৎসা প্রদানের কারো কাছ থেকে ব্যবস্থাপত্রের জন্য অর্থ গ্রহন করেন না। ফার্মেসীর মাধ্যমে মাসে গড়ে ৮০০০ (আট হাজার) টাকা আয় হয়। এর মাধ্যমেই সে তার বাবা-মাসহ আট সদস্য’র সংসার পরিচালনা করে। পাশাপাশি তার বাড়িতে কিছু সবজি চাষ, অল্প মাছ চাষ করে নিজ পরিবারের চাহিদা মেটায়।
নিরলস প্রচেষ্টাই তার এই সফলতা এনে দিয়েছে। ইব্রাহিম উদার মনের মানুষ, সুনাম নিয়েও সে ভাবেনা। মানুষের কল্যাণে সে বড় তৃপ্তি পায়। শত সমস্যায়ও তার মুখ সর্বদা হাসিখুশি। ক্ষুদ্র সরিসরে জন্ম নিয়ে প্রতিবন্ধী ইব্রাহিম খলিল মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নে প্রতিবন্ধীবান্ধব সমাজ বিনির্মানে সক্ষম হয়েছে। কল্যাণ বিলিয়ে মানুষের অন্তরে স্থান করে নিয়েছে। ইব্রাহিম এখন ‘পরোপকারি ডাক্তার ইব্রাহিম’।