বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বরগুনা সদর উপজেলার সাগর ঘেঁষা গ্রামটির নাম সোনাতলা। একেবারেই প্রত্যন্ত অঞ্চল। ক্ষুদ্র কৃষক ও জেলেদের বাস এই গ্রামে। ওয়াপদা বেড়ী বাঁধের ভিতরে ও বাইরে ৩৭৮ পরিবারের বাস। এরা দরিদ্র ও অতিদরিদ্র। খারাপ যোগাযোগ ব্যবস্থা ও দূরত্বের কারনে সচরাচর এখানের মানুষরা আনুপাতিকহারে সকল সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। সাগরের সন্নিকটে হওয়ায় দুর্যোগ ঝুঁকির মধ্যে এই পরিবারগুলো সবসময় আপদের দিন গোণে। বেড়ী বাঁধের বাইরের পরিবারগুলো বর্ষা মৌসূমে প্রতি অমাবষ্যা-পূর্ণিমায় প্লাবিত হয়। অনেকেই সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেনা।
এই এলাকার মানুষের উন্নয়নের উদ্দেশ্য নিয়ে সংগ্রাম নলটোনা শাখার কার্যক্রম শুরু করে। দরিদ্রতার কবলে পরে ঋণপ্রাপ্তি থেকে বাদ যাওয়া মানুষের মধ্যে ঋণ প্রদানের প্রত্যয় নিয়ে এই শাখায় ২০০৩ সন থেকে অতিদরিদ্রদের জন্য ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চলমান আছে। ২০১৩ ডিসেম্বর থেকে এর সাথে যুক্ত হয়েছে ইউপিপি-উজ্জীবিত প্রকল্প। যেহেতু এই এলাকায় বেশ কিছু ক্ষুদ্র চাষি রয়েছে এবং তারা সবজি উৎপাদনের সাথে যুক্ত। পাশাপাশি আয়বর্ধনের সুযোগ সৃষ্টির জন্য একটি লাগসই প্রকল্প গ্রহনের জন্য চেষ্টা চলছিল। কেঁচো চাষ ও কম্পোষ্ট উৎপাদন একটি লাভজনক ব্যবসা। এর জন্য বেশি সময় ও জায়গা নষ্ট হয়না। একজন নারী বাড়ির অন্য কাজ শেষ করে অবসর সময়ে কেঁচো চাষ করতে পারেন। এ বিষয়টি সামনে রেখে এই এলাকার ‘সোনাতলা মহিলা সমিতি’ ও ‘বুলবুলি মহিলা সমিতিতে’ প্রশিক্ষণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ‘কেঁচো সার উৎপাদন ও ব্যবহার’ প্রশিক্ষণে সদস্যরা মত পোষণ করে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে তাই সোনাতলার রেবা বেগম (স্বামী-আবদুর রব) এর বাড়ি গত ২২ থেকে ২৩ ডিসেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত দুইদিন কেঁচো সার উৎপাদন ও ব্যবহার বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়। এতে এই এলাকার ২৫জন নারী অংশগ্রহন করে। এই প্রশিক্ষণের উদ্বোধন করেন বরগুনার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শাহিনুর আজম খাঁন। পিকেএসএফ থেকে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে পর্যবেক্ষণ করেন ইউপিপি-উজ্জীবিত পিকেএসএফ প্রতিনিধি গোলাম মোস্তফা। প্রশিক্ষণ শেষে প্রত্যেক নারী কেঁচো চাষীকে ইউপিপি-উজ্জীবিত প্রকল্পের মাধ্যমে অনুদান হিসেবে ৮০০ কেঁচো প্রদান করা হয়। প্রশিক্ষণে প্রাপ্ত সম্মানী থেকে তাঁরা তাৎক্ষণিকভাবে কেঁচো সংরক্ষণের জন্য চারি কিনে নিয়ে যায়।
প্রকৃতির লাঙল হিসেবে পরিচিত ফেলনা কেঁচো এখন গ্রামের মানুষের আয়ের প্রধান উৎস। বাড়ির গৃহিনীরা পারিবারিক কাজের পাশাপাশি কেঁচো চাষ করছে। কারো রান্নাঘর, শোবার ঘর, গোয়াল ঘর, বারান্দা, ঘরের আঙিনায় সাজানো রয়েছে চাড়ি । প্রতিটি চাড়িতে রয়েছে কেঁচো আর কম্পোষ্ট সার। ঐ ২৫জন থেকে এখন ৫০ জন নারী কেঁচো চাষ ও কম্পোষ্ট উৎপাদনের সাথে জড়িত। আগামীতে এই গ্রামের শতভাগ নারী কেঁচো চাষ ও কম্পোষ্ট উৎপাদনের সাথে জড়িত হোক এটাই তাদের প্রত্যয়।
গত ৮ মাসে সোনাতলা গ্রামের নারীরা প্রত্যেকে গড়ে প্রায় ৩ হাজার টাকার কেঁচো ও প্রায় ১ হাজার ৫০০ টাকার কম্পোষ্ট সার বিক্রি করেছেন। ১ কেজি কেঁচো ১হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা দরে এবং এক কেজি কম্পোষ্ট সার ১০ থেকে ১৫ টাকা দরে বিক্রি করেন। কেঁচো চাষ ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন একটি লাভজনক ব্যবসা। বাড়ির কাজের পাশাপাশি এই কাজটি করা হয়।
সোনাতলা গ্রামের নারীগণ ফিরিয়ে আনতে চান প্রাকৃতিক কৃষি ব্যবস্থাপনা, দায়িত্ব নিয়েছেন নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের। শুধু নিজেরা এগিয়ে গেলেই লক্ষ্য অর্জন সফল হবে না, তাই একই দলে আনতে চান গ্রামের সকল নারীদের। এই লক্ষ্যেই প্রশিক্ষিত করছেন পাশাপাশি বাড়ির অন্য নারীদের। অগ্রসর চিন্তার অধিকারী এই নারীদের স্বপ্ন একদিন সফল হবেই, সোনার বাংলা ভরে উঠবে সোনালী ফসলে-যা হবে নিরাপদ এবং প্রকৃতিকে করবে ছন্দময়।