সমৃদ্ধিময় জয়নুদ্দিনের জীবন

মোঃ জয়নুদ্দিন, পিতাঃ হোসেন উদ্দিন, মাতার নামঃ মনু বিবি, গ্রাম ঃ নিজলাঠিমারা, ইউনিয়নঃ পাথরঘাটা সদর, উপজেলাঃ পাথরঘাটা, জেলাঃ বরগুনা। ৪ জানুয়ারী ১৯৪৮খ্রিঃ নিজলাঠিমারা গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে সবার ছোট জয়নুদ্দিন বাবার অভাবের সংসারে স্কুলে যাওয়ার কোন সুযোগ না পেয়ে অল্প বয়সেই দিনমজুরের কাজ শুরু করে অন্যের বাড়িতে। গ্রাম বলে কথা অল্পের মধ্যেই জয়নুদ্দিন বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করেন । তার সংসার জীবনে দু’টি কন্যা সন্তান ভুমিষ্ঠ হয়। তার নিজ এলাকায় দিন মজুরের কাজ না পাওয়ায়, উপকুলীয় এলাকায় বাড়ী হওয়ার সুবাদে পাথরঘাটা ইউনিয়নের লালদিয়ার চরে মাছ ধরার কাজে যেতেন জয়নুদ্দিন। একদিন হঠাৎ বিষক্ত জলজ প্রাণীতে পায়ে কামড় দেওয়ায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এলাকায় বিভিন্ন ওঝা-ফকির দেখানো হলেও কোন কাজ হয়নি। এরমধ্যে পায়ের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়ে। অর্থের অভাবে কোন উন্নত চিকিৎসা করাতে পারে না। কোন কাজ না করতে পারায় তার সংসারে টানপোড়ন শুরু হয়। সহায় সম্বল যেটুকু ছিল তা বিক্রি করে সংসার ও চিকিৎসা চালিয়ে যায়। ইতিমধ্যে এলাকার বিত্তবানরা চাঁদা সংগ্রহ করে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা পাঠায়। চিকিৎসা শেষে চিকিৎসকগণ তার পাদু’টি কেটে ফেলেন। জয়নুদ্দিনের পাদু’টি কেটে ফেলায় হুইল চেয়ারে চলাচল করতে হয়। অকর্মন্য হয়ে পড়ে জয়নুদ্দিন। অকর্মন্য জয়নুদ্দিনের চার জনের সংসারে ক্ষুধার জ্বালা মিটাতে ঋণ গ্রহন করে। ক্রমান্বয়ে ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ে। সংগতি না থাকায় ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারে না। সংসারে অভাবের কারনে বাধ্য হয়ে জয়নুদ্দিন ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করে।
সংগ্রাম (সংগঠিত গ্রামোন্নয়ন কর্মসূচী) ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) -এর সহযোগিতায় পাথরঘাটা উপজেলার পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নে সমৃদ্ধি কর্মসূচি শুরু করে। সমৃদ্ধি কর্মসূচি ২০১০ খ্রিঃ পাথরঘাটা ইউনিয়নে ভিক্ষুকের উপর জরিপ কাজ পরিচালনা করা হয়। জরিপে জয়নুদ্দিন একজন অসহায় ভিক্ষুক হিসেবে উঠে আসে। ২০১৪ সনে সমৃদ্ধি কর্মসূচির আওতায় ভিক্ষুকদের পূণর্বাসনের একটি উদ্যোগ নেয়া হয়। এতে পর্যায়ক্রমে ভিক্ষুকদের পূণর্বাসনের জন্য তালিকাভুক্তি করা হয়। প্রতিবন্ধীতা, অসহায়ত্ব ও দারিদ্রতা বিবেচনা করে জয়নুদ্দিনকে দ্বিতীয় দফার পাঁচ জনের মধ্যে নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়। সংগ্রামের সমৃদ্ধি কর্মসূচির সমাজ উন্নয়ন সংগঠক (এসডিও) জয়নুদ্দিনের সাথে আলোচনায় বসে এবং তার পূণর্বাসন পরিকল্পনা তৈরী করে। ২৫ জুন ২০১৫খ্রিঃ তারিখে তাঁর নিজ নামের হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে ১,০০,০০০/-(এক লক্ষ) টাকার চেক প্রদান করাা হয়। পূণর্বাসন পরিকল্পনার আলোকে একটি বাচুরসহ তিনটি গরু ক্রয় করে এবং অবশিষ্ট টাকা দিয়ে পাথরঘাটা ইউনিয়নের টেংরা বাজারে একটি দোকান শুরু করে। যেখানে মুদি, মনিহারী ও চা-পান এবং পানীয় বিক্রি হয়। জয়নুদ্দিন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হওয়ায় সার্বক্ষণিক দোকানে বসে থাকে। ফলে প্রচুর বেচাকেনা হয়। অল্পদিনে জয়নুদ্দিন ব্যবসায় সফল হয়। প্রতিদিন দোকান থেকে দুইশত থেকে আড়াইশত টাকা আয় হয়। পাশাপাশি গরু’র দুধ বিক্রি করে কিছু আয় হয়। তার মেয়ে ও স্ত্রী গরু দেখাশোনা করে। ভিক্ষার জীবনের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা তাকে খুব ব্যথিত করেছিল। যার ফলে নতুন এই উদ্যোগটি সে মনে-প্রাণে এমনভাবে আকড়ে ধরেছে যে, সে আর ভিক্ষার জীবনে কখনোই ফিরে যেতে চায় না। যে এলাকার মানুষ ভিক্ষুক জয়নুদ্দিন বলতো, তারাই এখন দোকানদার জয়নুদ্দিন বলে। এটা তার কাছে বড়ই সম্মানের। জয়নুদ্দিনের দোকানে বর্তমানে সৌর বিদ্যুতের সংযোজন হয়েছে। সৌর বিদ্যুতের আলোর মত জয়নুদ্দিনের জীবন যেন সমৃদ্ধির আলোতে এখন আলোকিত। জয়নুদ্দিনের জীবন এখন সমৃদ্ধিময় জীবন।

Scroll to Top